Sunday 8 August 2021

ASTOKALER ROBI

 

অস্তকালের রবি
পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়

ছয় ফুট দুই ইঞ্চি দীর্ঘকায় বৃষস্কন্ধ রবীন্দ্রনাথকে বিধাতা আশ্চর্য প্রতিভার সঙ্গে দরাজ হাতে দিয়েছিলেন অটুট স্বাস্থ্য, বিরল সৌন্দর্য। ছেলেবেলায় কুস্তি লড়েছেন, নতুন দাদার কাছে অশ্বারোহণ শিখে ঘোড়া ছোটাতেন দুরন্ত বেগে। শিলাইদহে থাকতে সাঁতরে পদ্মা পেরিয়েছেন। কবি বলতেন, ‘শরীরটা ছিল একগুঁয়ে রকমের ভালো।’
সতেরো বছর বয়সে বিলেত গিয়ে কাকভোরে স্নান করতেন বরফগলা জলে। বারণ করতেন গৃহকর্ত্রী মমতাময়ী মিসেস স্কট, আশঙ্কা প্রকাশ করতেন অসুখের। বিলেতের স্যাঁতসেঁতে ভোরের ঠান্ডায় রোজ স্নান সেরেও দিব্যি সুস্থ ছিলেন। কারণ? কবির কথায়, ‘ছেলেবেলা থেকে আমার শরীরে ব্যামো হওয়ার গেট বন্ধ।’
অবশ্য পরে কবি জীবনের বিভিন্ন সময়ে অর্শের উৎপাত, কোমরে ব্যথা, নিউরালজিয়া, ইরিসিপেলাস প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম বড় সঙ্কটজনক অসুখ হয়েছিল ১৯৩৭-এর ১০ সেপ্টেম্বর। সেদিন শান্তিনিকেতনে গল্প করতে করতে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান। ইরিসিপেলাসের আক্রমণ। কীভাবে কবি মৃত্যুর চার বছর পূর্বে হঠাৎ অচৈতন্য হয়ে পড়েন সে সম্বন্ধে হেমন্তবালা দেবীকে জানান (৯ অক্টোবর ১৯৩৭), ‘বারান্দায় বসে সন্ধ্যার সময় সুনন্দা, সুধাকান্ত ও ক্ষিতিমোহনবাবুর স্ত্রীকে মুখে মুখে বানিয়ে একটা দীর্ঘ গল্প শুনিয়ে তারপরে বাদলা বাতাস ঠান্ডা বোধ হওয়াতে ঘরে গিয়ে কেদারাতে বসেছিলুম, শরীরে কোনো প্রকার কষ্ট বোধ করিনি, অন্তত মনে নেই; কখন মূর্চ্ছা এসে আক্রমণ করল কিছুই জানি নে। রাত ন’টার সময় সুধাকান্ত আমার খবর নিতে এসে আবিষ্কার করলে আমার অচেতন দশা। পঞ্চাশ ঘণ্টা কেটেছে অজ্ঞান অবস্থায়, কোনো রকম কষ্টের স্মৃতি মনে নেই। ইতিমধ্যে ডাক্তার এসে রক্ত নিয়েছে, গ্লুকোজ শরীরে চালনা করেছে, কিন্তু আমার কোনো ক্লেশবোধ ছিল না। জ্ঞান যখন ফিরে আসছিল তখন চৈতন্যের আবিল অবস্থায় ডাক্তারদের কৃত উপদ্রবের কোনো অর্থ বুঝতে পারছিলুম না।’
কলকাতা থেকে ছুটে আসেন ডাঃ নীলরতন সরকার। সঙ্গে আরও কয়েকজন চিকিৎসক। প্রিয় বন্ধুর রোগশয্যায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেগে থাকেন নীলরতন। বন্ধুর সাহচর্য ও সুচিকিৎসায় অচিরেই কবি স্বমহিমায় পরিহাসমুখর।
কলকাতা থেকে অমিয়া দেবী আসেন তাঁকে দেখতে। তিনি ঘরে প্রবেশ করতেই কবি বললেন, ‘তুমি কে? তোমাকে তো আমি চিনতে পারচি না, আমি কোথায়, কলকাতায় না শান্তিনিকেতনে? তুমি কীসে এলে ট্রামে না বাসে?’
কবির কাছে দাঁড়িয়ে সুধাকান্ত রায়চৌধুরী, মাথায় তাঁর বিরাট টাক, কবি বলতেন ‘বলডুইন’—আবার শান্তিনিকেতনে হিন্দিভাষী অতিথিদের দেখাশোনা করতেন বলে কখনও ডাকতেন ‘সুধোড়িয়া’।
বলডুইন-সুধোড়িয়া চিন্তিতস্বরে বলে ওঠেন, ‘ইনি কিশোরীবাবুর স্ত্রী, কলকাতা থেকে আপনাকে দেখতে এসেচেন।’
উত্তরে কবি বললেন, ‘ভালো হয়েচে, কিশোরীকে বোলো আমার বই-এর প্রুফগুলো যেন ভালো করে দেখে।’
কবির এসব কথা শুনে আশপাশে যাঁরা ছিলেন ভয় পেয়ে গেলেন, বুঝতে পেরে রবীন্দ্রনাথ হাসেন, বললেন, ‘খুব বুদ্ধিমান যা হোক তোমরা। একটু অর্ধচৈতন্য অবস্থার অভিনয় করে দেখছিলাম তোমাদের মুখ-চোখের অবস্থা কেমন হয়, তা হোক সত্য যখন চৈতন্য ছিল না তখন তোমাদের অবস্থা কেমন যে ছিল বুঝে নিয়েছি।’
কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠে রামানন্দ-তনয়াকে কবি জানান, ‘শান্তা, হাবুডুবু দেহটাকে পাঁচ-দশটা ডাক্তার জাল ফেলে অতলের থেকে টেনে তুলেছে। বোধহয় মনটা এখনও সম্পূর্ণ ডাঙায় ওঠেনি। তার কাজ চলছে না পুরো পরিমাণে। থাক কিছুদিন জলে স্থলে বন্যা নেমে যাওয়া খাটের কাছটায়।’
আরোগ্যের পর ডাঃ নীলরতন সরকারের উদ্দেশে একটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘অন্ধ তামস গহ্বর হতে ফিরিনু সূর্যালোকে/ বিস্মিত হয়ে আপনার পানে হেরিনু নূতন চোখে।’
নূতন চোখে নিজেকে দেখার যে প্রাথমিক কবিতাগুলি, তা সংকলিত হয় ‘প্রান্তিক’-এর কবিতায় (পৌষ ১৩৪৪)। তার পরবর্তী কয়েকটি এবং পূর্ববর্তী কয়েকটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত ‘সেঁজুতি’—কাব্যখানি কবি উৎসর্গ করেন ‘ডাক্তার সার নীলরতন সরকার বন্ধুবরেষু’। রবীন্দ্রনাথ ‘সেঁজুতি’ সম্বন্ধে বলতেন—‘সন্ধ্যাবেলার প্রদীপ হিসাবে ওর মানেটা ভালো।’
গভীর বেদনার মাঝে যিনি বলেন ‘দুঃখের দিনে লেখনীকে বলি/ লজ্জা দিয়ো না’—শরীরের শত বাধার উপর দিয়ে হেঁটে চলে গেছেন কণ্টকিত রক্তমাখা চরণে, ব্যাহত হয়নি তাঁর দশবিধ কর্ম, হারিয়ে যায়নি চির পরিহাস-মুখর প্রাণপ্রাচুর্য।
১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। কবির প্রাতরাশের সময় উপস্থিত চন্দ-দম্পতি।
সেক্রেটারি অনিল চন্দ টেবিলের পাশে রাখলেন রবীন্দ্রনাথের একটি ফোটো, কেউ একজন তাতে সই নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। ফোটোখানিতে কবির মুখে আলো-ছায়াতে ফুটে উঠেছে যেন ঐশী ভাব।
কবি ছবিখানি হাতে নিয়ে রানি চন্দকে গম্ভীর-কণ্ঠে বললেন, ‘আমার এই ফোটোটায় ওরা কেউ কেউ বলে রোদ্দুর পড়ে এমনি হয়েছে। আমি বলি ও আমার জ্যোতি ফুটে বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। এ কি আর সবার ছবিতে হয়। হবে কি তোমার ফোটোতে।’ বলে হেসে সেক্রেটারির দিকে কটাক্ষপাত করলেন।
অনিল চন্দ গর্বের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘জানেন আমার ফোটো তুলে শম্ভুবাবু বিদেশে কম্পিটিশনে প্রাইজ পেয়েছেন।’
রবীন্দ্রনাথ চোখ বড় বড় করে কপাল টানা দিয়ে বললেন, ‘বটে! এটা প্রাইজ না হোক আমার কাছে সারপ্রাইজ তো বটেই!’
সবাই হো হো করে হেসে ওঠেন।
কালিম্পঙের গৌরীপুর ভবনের বিরাট অট্টালিকায় এক দুপুরে কবির বার্ধক্যে ন্যুব্জ দীর্ঘদেহ টলমল করে, শোওয়ার খাট থেকে উঠতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যান। ‘আমি চৌকি থেকে উঠতে গিয়ে পড়ে গেলুম। হ্যাঁ পতন হল। অধঃপতন থেকে রক্ষা করবার জন্য তোমরা তো কেউ ছিলে না,’ দুপুরবেলা খাবার টেবিল ছেড়ে ছুটে-আসা মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেন।
শারীরিক কষ্টের মাঝেও নিজেকে নিয়ে পরিহাস। কালিম্পঙের সেই গৌরীপুর ভবনেই ১৯৪০-এর ২৬ সেপ্টেম্বর কবির প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের অসুখে ইউরিন বন্ধ হয়ে যে বিপদ ঘনিয়ে এসেছিল তারই জের চলে ১৯৪১-এর বাইশে শ্রাবণ পর্যন্ত। রোগের বিষক্রিয়ায় আচ্ছন্ন কবি—সেই দুঃসময়ে উপস্থিত শুধু প্রতিমা দেবী, মৈত্রেয়ী দেবী—দুই নিরুপায় নারী ও পুরাতন ভৃত্য বনমালী। অচৈতন্য রবীন্দ্রনাথের জরুরি চিকিৎসার জন্য মৈত্রেয়ী দেবী ছুটে গেলেন কালিম্পঙের মিশনারি হাসপাতালের মাইনে করা সাহেব ডাক্তারের কাছে—শত অনুনয়েও দয়া হল না, তিনি এলেন না। আকাশে তখন ঘোর দুর্যোগের অন্ধকার। বজ্র বিদ্যুতের কড়কড়ানি আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। মৈত্রেয়ী দেবী লিখছেন, ‘বাড়ি ফিরে দেখি, প্রতিমাদি অসুস্থ শরীরে বৃদ্ধ ভৃত্য বনমালীর সাহায্যে রোগী পরিচর্যায় রয়েছেন। সেই দীর্ঘ বিরাট অচৈতন্য দেহ নাড়াচাড়া করায় শক্তি দরকার। সেই দুঃসময়ে ঈশ্বর প্রতিমা দেবীর দুর্বল দেহে বল দিয়েছিলেন, মনে অসীম শক্তি দিয়েছিলেন।... মনে জোর করে ভাবতে লাগলুম, যা করণীয় সবই করা হয়েছে,—কলকাতায় খবর দেওয়া হয়েছে,—মংপুতেও লোক গেছে, এ জেলায় সবচেয়ে বড় ডাক্তারকেও খবর দেওয়া হল।... বেলা দুটো থেকে সন্ধে সাতটা পর্যন্ত সেই অপেক্ষা চলল।’
অনেক বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে প্রায়-অজ্ঞান রবীন্দ্রনাথকে নামিয়ে আনা হল শিলিগুড়িতে। তারপর ট্রেনে কলকাতা। ২৯ সেপ্টেম্বর জোড়াসাঁকোতে পৌঁছে দোতলার পাথরের ঘরে শুইয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। কবির চেতনা অল্প ফিরে এসেছে, বললেন—‘এ কোথায় আমাকে আনলে বউমা।’ কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রতিমা দেবী, বললেন, ‘এ যে আপনার পাথরের ঘর।’
কবি বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, পাথরই বটে, কী কঠিন বুক, একটুও গলে না।’
সেদিন ডাক্তারদের একটি জরুরি পরামর্শ সভা বসে জোড়াসাঁকো বাড়িতে। কম বয়সি ডাক্তাররা কেউ কেউ মনে করেন—বার্ধক্যে নীলরতন সরকারের পূর্ব-প্রতিভা অস্তায়মান। নবীন চিকিৎসকদের যুক্তি-তর্ক মন দিয়ে শোনেন তিনি।
সকলের বলা হয়ে গেলে, স্বভাবসুলভ মিষ্টি গলায় মৃদু হেসে ডাঃ নীলরতন বললেন, ‘আপনাদের কথা সবই ঠিক যে, এ অপারেশন খুবই সহজ। অনেকবার অনেক বৃদ্ধের রোগ আপনারা সারিয়েছেন, সামান্য একটা ফোঁড়া কাটার মতো ব্যাপার। সবই মানলাম, কিন্তু আপনারা একটা কথা মনে রাখছেন না যে, রোগী অন্য কোনও লোক নয় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সর্বসাধারণের মতো ওঁর ‘নার্ভাস সিস্টেম’ নয়। সুকুমার দেহ ওঁর, কাজেই অন্য লোকের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। খুব ভালো করে সুরে বাঁধা একটা বাদ্যযন্ত্রের মতো। বাইরে থেকে আঘাত করতে গেলে যে ধাক্কা শরীরে লাগবে, তাতে ওঁর সমস্ত দেহযন্ত্রটাই বিকল হয়ে যাবার আশঙ্কা। আমার মনে হয় না এই রিস্ক নেওয়া উচিত। ওষুধ দিয়েই এখন চিকিৎসা হোক না।’
দু’দিন পরে গান্ধীজির বার্তা নিয়ে ওয়ার্ধা থেকে এলেন মহাদেব দেশাই। তখনও দূর হয়নি কবির জীবন-আশঙ্কা। প্রতিমা দেবী লিখছেন, ‘মহাদেব দেশাই অনিলকুমারের সঙ্গে বাবামশায়ের ঘরে এসে মহাত্মাজীর সহানুভূতি, আন্তরিক প্রেম ও প্রীতি জানালেন। অনিলকুমার জোরে-জোরে মহাদেব দেশাই মহাশয়ের বার্তা গুরুদেবকে বুঝিয়ে দিলেন, কেন না তখন তিনি ভালো করে শুনতে পাচ্ছিলেন না। তাঁর চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল, চোখের জল তাঁর এই প্রথম দেখলুম। নার্ভের উপর এত বেশি সংযম তাঁর ছিল যে, অতি বড়ো শোকেও তাঁকে কখনো বিচলিত হতে দেখিনি, আজ যেন বাঁধ ভেঙে গেল।’
১৯৪১-এর ১৬ জুলাই। রবীন্দ্রনাথকে দেখতে বিধান রায় এলেন শান্তিনিকেতনে। সঙ্গে আরও কয়েকজন ডাক্তার। কবির কক্ষে নিস্তল নৈঃশব্দ্য ভেঙে বিধান রায় গম্ভীর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথকে বললেন, ‘দেখুন, আমরা আজ এসেছি আপনাকে বলতে যে আপনার এখন শরীরটা আগের চেয়ে একটু ভালো আছে, কাজেই অপারেশনটা করিয়ে ফেলা ভালো। তাতে আপনার এই যে জ্বর আর খাবারে অরুচি এবং অন্যান্য উপসর্গ সব চলে যাবে। আপনি আবার বেশ সুস্থ বোধ করবেন।’
‘কেন? আমি তো আজকাল আগের চেয়ে বেশ আছি। আস্তে আস্তে তাইতেই তো শরীরে জোর পাব,’ কবি বললেন।
‘শুধু তো খাওয়া নয়—আরো তো নানারকম উপসর্গ আছে। এ তো কিছু শক্ত অপারেশন নয়, ওটা করিয়ে ফেলাই ভালো। তাতে দেখবেন আপনার শরীরের সব কষ্ট, গ্লানি এখন যা অনুভব করছেন চলে যাবে।’
ডাঃ বিধান রায়ের কথায় ডাঃ ইন্দুমাধব বসু মাথা নেড়ে সায় দেন। কিন্তু সেকালের বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁর কবির অস্ত্রোপচার করার কথা তিনি কেন যেন গম্ভীর মুখে বসেছিলেন। বিধান রায় তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন—‘কী? কবে অপারেশন করবে?’
রাওয়ালপিন্ডির এক বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম, বিধানচন্দ্রের মতোই অকৃতদার এবং বয়সে তাঁর চেয়ে দু’বছরের বড় ললিতমোহনের শান্ত ও সংক্ষিপ্ত উত্তর ‘যেদিন তোমরা বলবে।’
গম্ভীর রবীন্দ্রনাথ নিঃশব্দে সব শুনলেন। ডাক্তাররাও আর কথা না বাড়িয়ে যেমন ঝড়ের মতো এসেছিলেন—ঝড়ের বেগেই বেরিয়ে গেলেন।
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলে বিধান রায় স্থির করেন—জুলাই মাসের শেষেই অপারেশন করিয়ে ফেলতে হবে।
বাকসম্রাট সেদিন নির্বাক। তখন কবি ছিলেন কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থের চিকিৎসাধীন। তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট কমলাকান্ত ঘোষ বেশ কিছুদিন যাবৎ রয়েছেন শান্তিনিকেতনে, অপারেশনের সিদ্ধান্তের কথা শুনে সেখানে উপস্থিত রানি মহলানবিশকে বলেন, ‘আমাদের একটু সময় দিলেন না এঁরা। এই ক’দিনের ওষুধেই তো উনি একটু ভালো আছেন আজকাল।’
আসলে এই কথাগুলিই রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছিলেন বিধান রায়কে কিন্তু তিনি তা মানতে রাজি নন। কয়েকদিন আগে ৪ জুলাই রথীন্দ্রনাথকে কবি করুণ হেসে আকুলস্বরে শেষবারের মতো বলেন, ‘রথী, কবিরাজমশাই তো বলেছেন, তিনি খুবই আশা করেন তাঁর ওষুধেই আমাকে ভালো করে তুলবেন। তবে একটু সময় লাগবে। আঃ বাঁচি, যদি কাটা-ছেঁড়া না-করতে হয়।’
কবি কিছুদিন থেকেই বলছিলেন— ‘আর ক’দিনই বা বাকি আছে? এ ক’টা দিন দিক না আমাকে যেমন আছি, তেমনি করে থাকতে। কোনওদিন তো আমাকে যেতেই হবে। কিন্তু আমি কবি। এই পৃথিবী থেকে ঝরে পড়তে চাই শুকনো পাতার মতো। যাবার আগে আমাকে নিয়ে এই টানাছেঁড়া কেন?’
দিল্লি থেকে কলকাতা ফিরে বিধান রায় অপারেশন না-করানোর কথা শুনে ক্ষিপ্ত হন। বললেন ‘না, কিছুতেই নয়, অপারেশন ছাড়া উপায় নেই। নইলে সারাদেশ আমাদের অপরাধী বানাবে। চিকিৎসাশাস্ত্রে অপারেশনই এই অবস্থায় একমাত্র প্রতিকার।’
কবির টানাছেঁড়া করার দুঃস্বপ্নের অনুভূতিকে উপেক্ষা করে বহাল রইল অপারেশনের সিদ্ধান্ত। ২৪ জুলাই সকাল থেকেই তিনি চঞ্চল, পরের দিন চলে যেতে হবে শান্তিনিকেতন ছেড়ে, তিনি জানেন— আর কখনও ফিরবেন না। সেদিন বিকেলের গাড়িতে রথীন্দ্রনাথ আর অনিল চন্দ চলে যাবেন কলকাতায়, কবি পৌঁছবার আগেই এগিয়ে থাকতে। অনিল চন্দ প্রণাম করে বললেন— ‘গুরুদেব, আপনার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি।’
‘গাড়ির ব্যবস্থা না মারবার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছ?’ বললেন রবীন্দ্রনাথ।
‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ গুরুদেব, এ কী অন্যায় কথা। এরকম কথা বলা আপনার মোটেই উচিত নয়’, বলে আপত্তি জানালেন অনিল চন্দ।
রবীন্দ্রনাথ বেলাশেষের ম্লান আলোর মতো হেসে বললেন— ‘বাঙাল ঠাট্টাও বোঝে না।’
বিস্ময়ের ব্যাপার, কবিকে কলকাতায় নিয়ে আসার পর— কবে অপারেশন হবে সেই তারিখটা পর্যন্ত গোপন রাখা হয়। ৩০ জুলাই যেদিন অপারেশন হবে সেদিন কয়েক ঘণ্টা আগেও তাঁকে কিছু জানানো হয়নি।
জোড়াসাঁকো বাড়িতে কবির ঘরের পুব দিকের বারান্দায় অস্ত্রোপচারের সব আয়োজন প্রস্তুত। কিন্তু কিছুই জানেন না কবি। সেদিন সকালে তিনি ডাঃ জ্যোতিপ্রকাশকে শুধোন ‘ব্যাপারটা কবে করছো তোমরা?’
ডাঃ জ্যোতিপ্রকাশ সরকারের নির্বিকার দায়সারা গোছের উত্তর, ‘এই কাল কি পরশু— এখনও ঠিক হয়নি। ললিতবাবু যেদিন ভালো বুঝবেন সেই দিনই হবে।’
সেদিনই অপারেশন হচ্ছে না জেনে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত কবি কিছুক্ষণ পরই রানি চন্দকে মুখে মুখে বললেন একটি অসমাপ্ত কবিতার শেষ তিনটে পঙ্‌঩ক্তি।
‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।’
একটু পরেই এলেন রানি ও প্রশান্ত মহলানবিশ। কবির কাছে যেতেই বললেন,— ‘কি হে প্রশান্ত, আজকের যুদ্ধের খবরটা কী?’
প্রশান্ত বললেন, ‘একটু যেন খবর ভালো। আজকের কাগজ পড়ে তো মনে হচ্ছে যে, রাশিয়ান সৈন্য জার্মানদের ঠেকাতে পেরেছে। অত তাড়াতাড়ি আর এগতে পারছে না।’ শুনে কবির মুখ খুশিতে উজ্জ্বল বললেন, ‘পারবে, পারবে ওরাই পারবে। ভারী অহঙ্কার হয়েছে হিটলারের।’
একটু পরেই উপস্থিত হলেন শল্য চিকিৎসক ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, কবির কাছে এসে বললেন, ‘আজ দিনটা ভালো, আজই তাহলে সেরে ফেলি, কী বলেন?’
রবীন্দ্রনাথ প্রথমটায় যেন চমকে উঠলেন, ‘আজই?’
তারপর সমুখে প্রশান্ত-রানিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,— ‘তা একরকম ভালোই। এরকম হঠাৎ হয়ে যাওয়া মন্দ নয়।’ এরপর কবি একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।
আসল অপারেশন— প্রস্টেট কাটা নয়, শুধু একটা জায়গা ফুটো করে ইউরিন বেরনোর রাস্তা করে দেওয়া। চিকিৎসাশাস্ত্রে যাকে বলে সুপ্রা পিউবিক সিস্টোস্টমি। কিন্তু বড় অপারেশন দূরে থাক, ওই ছোট অপারেশনেই হয়ে গেল সেপটিক, ইউরেমিয়া শরীরে বসল জাঁকিয়ে।
দুপুর ১১টা ২০ মি থেকে ১১টা ৪৫ মি— পঁচিশ মিনিটের অপারেশন। ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করানো হয়নি। লোকাল এনাস্থেশিয়া। অপারেশন শেষ হবার পর কবিকে তাঁর খাটে এনে শোয়ানোর পর প্রশান্ত ও রানি মহলানবিশ গেলেন দেখতে। রানিকে দেখতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ বিরক্তমুখে বললেন, ‘জ্যোতি মিথ্যে কথা বলেছে। কেন বলেছিল যে কিছু লাগবে না। আমার খুব লেগেছে— এত কষ্ট হচ্ছিল যে, আমি জোর করে ঠোঁট টিপে চোখ বুজে পড়ে রইলুম— পাছে আমার মুখ দিয়ে কোনোরকম আর্তনাদ বেরিয়ে যায়।’ বলতে বলতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
সন্ধে সাতটা নাগাদ ডাঃ ললিতমোহন জিজ্ঞেস করলেন, ‘অপারেশনের সময় আপনার কি লেগেছিল?’
রবীন্দ্রনাথ বললেন— ‘কেন মিছে কথাটা বলাবে আমাকে দিয়ে?’
৩১ জুলাই: কবি বলছেন, জ্বালা করছে, ব্যথা করছে। নিঃসাড় হয়ে আছেন, গায়ের তাপ বাড়ল।
১ আগস্ট: অসাড় হয়ে আছেন। যন্ত্রণাসূচক শব্দ করছেন— হিক্কা উঠছে।
২ আগস্ট: আগের রাতের মতনই আচ্ছন্ন অবস্থা। কিছু খাওয়াতে গেলে বিরক্তি প্রকাশ করছেন ‘আঃ, আমাকে আর জ্বালাস নে তোরা।’
রানি চন্দ কাছে গিয়ে বলেন— ‘কষ্ট হচ্ছে কিছু?’
কবি বললেন, ‘কী করতে পারবে তুমি? চুপ করে থাকো।’
একজন ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রকম কষ্ট হচ্ছে আপনার?’
কষ্টের মধ্যেও যেন একটু ম্লান হাসি, বললেন, ‘এর কি কোনও বর্ণনা আছে?’
আগের দিন দুপুর থেকে হিক্কা আরম্ভ হয়েছে। থামছে না কিছুতেই। বিধান রায় কবিকে দেখে বেরিয়ে যাবার সময় মীরা দেবী ও রানি মহলানবিশকে দেখতে পেয়ে বললেন— ‘বাড়ির মেয়েরা তো কতরকম টোটকা ওষুধ জানে, তোমরা দাওনা টোটকা-টুটকি কিছু হিক্কার জন্য। আমাদের দেশে তো নানারকমের টোটকা আছে এইসব ছোটখাট কষ্ট সারাবার জন্য।’
৩ আগস্ট: ওষুধ কি পথ্য খাওয়াতে গেলে বিরক্ত হচ্ছেন। দুপুরে কবির নাতনি নন্দিতা গিয়ে বললেন, ‘রানি মাসি বলছেন একটু জল খাওয়া দরকার, এটুকু খেয়ে নাও।’
—‘যিনিই বলুন না কেন! আমি কারো কথাই আর শুনছি নে। তোরা আর জ্বালাসনে আমাকে।’ কবির চোখমুখে বিরক্তির চিহ্ন।
৪ আগস্ট: প্রতিমা দেবী কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাকলেন, ‘বাবামশাই, আমি এসেছি আপনার মামণি।’ একবার চোখ দু’টি জোর করে পুত্রবধূর দিকে তাকালেন আর সামান্য মাথা নাড়লেন।
ডাঃ সত্যসখা মৈত্র বললেন, তিনি যে আশঙ্কা করছিলেন সেটাই ঠিক— কিডনি ফেল করছে। রাত এগারোটার দিকে রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ ডান হাতখানি তুলে আঙুল ঘুরিয়ে অস্পষ্টস্বরে বললেন— ‘কী হবে কিছু বুঝতে পারছিনে— কী হবে।’ (এটাই কি শেষ উচ্চারণ—‘পথের শেষ কোথায়, কী আছে শেষে’ রূপকারের?)
৫ আগস্ট: সারাদিন একই অবস্থা। সন্ধ্যার সময় স্যার নীলরতনকে নিয়ে এলেন বিধান রায়। আগে ঢুকলেন নীলরতন, পিছনে বিধান রায়। নীলরতন পায়ে পায়ে গিয়ে কবির খাটের কাছে দাঁড়ালেন, কবির কোনও সাড়াশব্দ নেই। বিধান রায় রানি মহলানবিশকে বললেন, ‘একবার ডাকো তো, দেখি জ্ঞান আছে কিনা।’
বিধান রায়ের কথানুযায়ী রানি কবির কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচিয়ে বলেন, ‘একটু জল খাবেন?’
কোনও সাড়া নেই। আবার যেই বললেন, ‘শুনছেন? একটু জল খাবেন?’
অমনি যেন চমকে বলে উঠলেন— ‘য়্যাঁ।’ কিন্তু মুহূর্তের জন্য। এবার বিধান রায় বললেন— ‘দাও তো মুখে একটু জল, দেখি খেতে পারেন কিনা।’
ওষুধ খাবার গ্লাসে জল নিয়ে মুখে একটু ঢেলে দিলেন। খানিকটা পেটে গেল, খানিকটা বাইরে গড়িয়ে পড়ল। বিধান রায় বললেন— ‘থাক হয়েছে।’
নীলরতন সরকার তখন রবীন্দ্রনাথের একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে গায়ে হাত বুলোচ্ছেন। এবার রবীন্দ্রনাথের কানের কাছে মুখ নিয়ে রানি মহলানবিশ উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘দেখুন কে আপনার কাছে এসেছেন। মেজমামা আপনাকে দেখতে এসেছেন।’
কোনও সাড়া নেই। আবার বললেন, ‘নীলরতনবাবু আপনাকে দেখতে এসেছেন।’ জ্ঞানের কোনও আভাসই নেই। নীলরতন সরকার গম্ভীর মুখে বললেন, ‘থাক হয়েছে, আর ওকে বিরক্ত কোরো না।’
বিষণ্ণ মুখে হয়তো অভ্যাসবশে নাড়ি দেখলেন, ঘড়ি বের করে রেসপিরেশন গুনলেন এবং তারপর সস্নেহে কবির হাতের উপর নিজের হাত বুলোতে লাগলেন। মনের বেদনা যেন আর চেপে রাখতে পারলেন না। যাবার সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের মাথার কাছ পর্যন্ত এসে একবার ঘুরে দাঁড়ালেন, রবীন্দ্রনাথকে আবার খানিক দেখলেন নীলরতন— তারপর দরজা পেরিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে চলে গেলেন।
৬ আগস্ট: কবির স্যালাইন চলছে, আনা হল অক্সিজেন। অবস্থা   সঙ্কটজনক।
১৯৪১-এর ৭ আগস্ট, বাইশে শ্রাবণ— বৃহস্পতিবার সকালবেলা ডাঃ ললিতমোহনকে সঙ্গে নিয়ে শেষবার রবীন্দ্রনাথকে দেখতে আসেন বিধানচন্দ্র। সেদিন মনে হল, এতবড় ধন্বন্তরী চিকিৎসকও কত অসহায়— রণক্ষেত্রে সব্যসাচীর কাঁধ থেকে যেন খসে পড়েছে গাণ্ডীব। মন্থর পায়ে নিঃশব্দে বিদায় নিলেন বলিষ্ঠ দীর্ঘদেহী রণপরাস্ত মানুষটি। ততক্ষণে রবীন্দ্র-বিসর্জনের সকরুণ সুর অশ্রুভরা বেদনা হয়ে ঝরে পড়ছে শ্রাবণ-আকাশে।
কবির কানের কাছে অবিরাম পড়া হচ্ছে তাঁর জীবনের বীজমন্ত্র— ‘শান্তম্‌ ঩শিবম্‌ ঩অদ্বৈতম্‌।’ বাইরে বারান্দায় মৃদুকণ্ঠে কে যেন গেয়ে চলেছে— ‘কে যায় অমৃত যাত্রী।’
সবাই জেনে গিয়েছেন— তাঁর যাবার আয়োজন— আলো আর ছায়ায় মেশা রহস্যময় জগৎ হতে ফিরে এসে আর বলবেন না— ‘দেখলাম অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলায় দেহ মোর ভেসে যায় কালো কালিন্দীর স্রোত বাহি নিয়ে অনুভূতিপুঞ্জ।’
এর পরের দৃশ্য স্বয়ং আগাম লিখে রেখে গেছেন ‘জন্মদিনে’।
‘অলংকার খুলে নেবে, একে-একে বর্ণসজ্জাহীন উত্তরীয়ে
ঢেকে দিবে, ললাটে আঁকিবে শুভ্র তিলকের রেখা;
তোমরাও যোগ দিয়ো জীবনের পূর্ণ ঘট নিয়ে
সে অন্তিম অনুষ্ঠানে, হয়তো শুনিবে দূর হতে
দিগন্তের পরপারে শুভ শঙ্খধ্বনি।’
 অঙ্কন : সুব্রত মাজী





###################################################

Ill health is powerlessness: a phenomenological study about worthlessness, limitations and suffering

First published: 17 May 2004
 
Citations: 47
Margaretha Strandmark K., Nordic School of Public Health, Box 121333, S-40242 Göteburg, Sweden.
E-mail: margarethastrandmark@hotmail.com (or) margaretha.strandmark@kau.se
Get access to the full version of this article.View access options below.

Abstract

The aim of the study was to create an understanding of the different dimensions of subjective ill health through discovering the essence of ill health, based on the individual experience. A philosophical, phenomenological method has been employed, and in-depth interviews were conducted with 25 individuals. The findings showed that the essence of ill health is powerlessness, which is made by a self-image of worthlessness, a sense of being imprisoned in one's life situation, and emotional suffering. The individual views her/himself as worthless, based on societal norms, attitudes and human models. Incapability and a sense of worthlessness cause the individual to distrust her/himself and others. She/he is imprisoned in her/his own life situation due to limited choices and ability. Such a situation gives rise to apathy. Destructive feelings of alienation, anguish, shame and guilt take over, and the individual's autonomy and existence are threatened. Stigmatization results from suffering and a sense of worthlessness. The informants compensated for their vulnerability by means of human support, intimacy with others, a society adapted to disability, living in the present and awareness.

No comments: